হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী সালমান রহমানের ৩৬ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৭:২২ পিএম | আপডেট: বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৭:২২ পিএম
পলাতক স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বেসামরিক, শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান দরবেশখ্যাত সালমান এফ রহমান নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। যার সবটাই বিদেশে পাচার করেছেন। দরবেশ (সালমান এফ রহমান) এতটাই ক্ষমতাধর ছিলেন যে, তাকে বাধা দেয়ার মতো কেউ ছিল না। তিনি ছিলেন স্বৈরাচারী হাসিনার পরিবারের একজন ‘ক্যাশিয়ার’। এ কারণে পেয়েছেন ইচ্ছেমতো লুটপাট করার সুযোগ। হাসিনার উপদেষ্টা হওয়ার পর তা আরও বেড়ে গিয়েছিল। সেই সুবাধে দেশের জনগণ তাকে দরবেশ নামে অভিহিত করেন। তার বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ারহোল্ডারদের হাজার কোটি টাকা লোপাট, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, কারচুপি, সন্ত্রাস, সাংবাদিকদের ওপর হামলাসহ বহু নারকীয় কর্মকান্ড চালান সালমান। তার এই ঋণ জালিয়াতি গত ১৫ বছরে ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র করে ৮ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২৩ সেপ্টেম্বর দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে দুদক উপপরিচালক ও অনুসন্ধান টিম প্রধান মনজুর আলম ওই তলবি চিঠি পাঠায়। তার বিরুদ্ধে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণপূর্বক আত্মসাতসহ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ আনেন।
তলবি চিঠিতে সোনালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ডাচ বাংলা ব্যাংক পিএলসির বিভিন্ন শাখা বরাবর পাঠানো হয়েছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানের স্বার্থে ব্যাংকগুলোর লোকাল শাখাসহ অন্যান্য শাখায় সালমান এফ রহমান ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রদত্ত ব্যক্তিগত ঋণ এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রæপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনুক‚লে প্রদত্ত বা বরাদ্দকৃত মোট ঋণের পরিমাণ, এ ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানত, ঋণ আবেদন-প্রস্তাব-অনুমোদন ও ঋণ বিতরণ, সুকুক বন্ডের বিপরীতে প্রদত্ত ঋণসহ বরাদ্দকৃত এবং বিতরণকৃত সব ঋণ সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র তলব করা হয়েছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওইসব নথিপত্র পাঠানোর অনুরোধ করেছিল দুদক। ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে গত ২২ আগস্ট অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
দরবেশখ্যাত এই ব্যক্তির নামে গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার পাশাপাশি পণ্য রফতানি করে দেশে টাকা না আনার অভিযোগও রয়েছে তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে। এভাবে নানা অনিয়ম করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন সালমান এফ রহমান। তিনি কত টাকার মালিক তার প্রকৃত হিসাব কারো কাছে নেই। ২০০৬-০৭ সালে সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে ঋণখেলাপিসহ নানা অভিযোগে জেলে গিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান। এরপর জেল থেকে বের হয়ে জড়ান ২০১০-১১ সালের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে। এতকিছুর পরও তাকে স্পর্শ করার সাহস হয়নি কারও।
অভিযোগ রয়েছে, গত ৩১ বছরে শেয়ারবাজারের প্রত্যেকটি বড় কেলেঙ্কারিতে সালমান এফ রহমান জড়িত। গত ৩ বছরে তিনি দৃশ্যমানভাবেই বাজার থেকে নিয়েছেন ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর অদৃশ্যভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সালমান এফ রহমান। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জাতীয় নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে যারা ভ‚মিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম সালমান এফ রহমান। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবসায়ী নেতার পর ২০১৮ সালে এমপি ও টানা দুইবার প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন তিনি। হাজারো ব্যবসায়ীকে পথে বসানো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির এক কারিগরের নাম দরবেশখ্যাত সালমান এফ রহমান।
২০১০-১১ সালে শেয়ার বাজার ধসের পর এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। সেই রিপোর্টে পুঁজিবাজারে ফিক্সড প্রাইস, বুক-বিল্ডিং, রাইট শেয়ার, ডিরেক্ট লিস্টিং, সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, প্রেফারেন্স শেয়ারসহ সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম হওয়ার এবং এর সঙ্গে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তাই খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সেই রিপোর্টে সালমান এফ রহমান থেকে পুঁজিবাজারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। এ ছাড়া সালমান এফ রহমান বিভিন্ন কোম্পানির প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও প্রমাণ পায় সেই কমিটি। অথচ এসব অনিয়মের সঙ্গে সালমান এফ রহমানসহ আরও কয়েকজনের নাম জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
২০০৬-০৭ সালের দিকে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী একটি টাস্কফোর্স করা হয়েছিল। টাস্কফোর্স বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য বের করেন যে, ১২২ জন রাজনৈতিক নেতা ও আমলা দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ মোট ১৭টি দেশে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া ৪৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এক হাজার কোটি টাকা সালমান এফ রহমানের। আমেরিকায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসার নামে এসব টাকা পাচার করা হয়েছিল। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ কার্যালয়ে ১০ দিনের রিমান্ডে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান (সালমান এফ রহমান)। রিমান্ডে তিনি নানা ধরনের তথ্য দিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, গোপন খবরের ভিত্তিতে গত ১৩ আগস্ট রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে নৌপথে পালানোর সময় সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হককে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের নিউমার্কেট থানায় করা হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে ঢাকা কলেজের সামনে সংঘর্ষে এক ছাত্র এবং এক হকার নিহত হন। পরে এ ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় দুটি হত্যা মামলা হয়। এই হত্যার ঘটনায় ইন্ধনদাতা হিসাবে সালমান এফ রহমানকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
গত ২২ আগস্ট রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেন, “আন্দোলনের সময় আমি শেখ হাসিনাকে বলেছি, দেশের মানুষ আমাদের ওপর ক্ষেপে যাচ্ছে। তিনি পাত্তা দেননি। ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন শেখ হাসিনা আমাকে প্রশ্ন করেন, পুলিশ এত ভালো কাজ করছে। সেনাবাহিনী কেন পারছে না। এ সময় আমি বিষয়টি নিয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিই।” তিনি আরও বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের সময় ২ বছর জেল খেটেছি। সুতরাং সমস্যা হবে না। আমাকে জেলে রাখলে দেশের ক্ষতি হবে। কারণ আমার নানা প্রতিষ্ঠানে অনেক কর্মী আছে। তারা বেতন পাবে না। ব্যাংক থেকে যেসব টাকা ঋণ নিয়েছি, সেগুলো পরিশোধ হবে না।’
আরও পড়ুন
- মাধবদীতে টেক্সটাইল মিল মালিককে পিটিয়ে হত্যা
- কেরানীগঞ্জে ব্যাংকে ঢুকে পড়া তিন ডাকাতের আত্মসমর্পণ
- কেরানীগঞ্জে ব্যাংকে ডাকাত, ঘিরে রেখেছে পুলিশ-জনতা
- ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা স্বেচ্ছায় সরে গেলে সাধারণ ক্ষমা, নইলে ব্যবস্থা’
- পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে ভারতে হিন্দু নির্যাতনের সাজানো সাক্ষাৎকার
- নরসিংদীতে সংঘর্ষে বর্তমান-সাবেক ২ ইউপি সদস্য নিহত
- মুন্নী সাহার ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন
- পাসপোর্ট সেবায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি, বেশি ঘুষ দিতে হয় বিচারিক সেবায় : টিআইবি