১০তলা মার্কেট বানাতে আগুন লাগানো হয় বঙ্গবাজারে
বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৮:০৫ পিএম | আপডেট: বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৮:০৫ পিএম
১০তলা ভবনের মার্কেট বানাতেই আগুন লাগানো হয় রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী বিপণি বিতান বঙ্গবাজারে। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে। গত বছরের ৪ এপ্রিল ভোরে সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখনই পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয় বঙ্গবাজারে। ভয়াবহ সেই আগুনে পুড়ে যায় মার্কেটটির চারটি ইউনিটসহ আশপাশের আরও তিন মার্কেট। দোকান, মালামাল ও নগদ টাকা পুড়ে নিঃস্ব হয়ে যান শত শত ব্যবসায়ী।
সে সময় তদন্তের নামে সিগারেট, মশার কয়েল এবং বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগার গল্প প্রচার করা হলেও রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আলোচিত এই অগ্নিকান্ডে পরিকল্পিত নাশকতার আলামত বেরিয়ে আসছে। এরই মধ্যে আগুন লাগার আগ মুহূর্তের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ এবং ব্যবসায়ীদের করা মামলা নিয়ে নতুন করে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। ওই রাতের আদর্শ মার্কেটের সামনের সিসিটিভি ক্যামেরার একটি ফুটেজ দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে। এতে দেখা গেছে, আগুন লাগার কিছুক্ষণ আগে দুই যুবক মোটরসাইকেলে করে বঙ্গ সুপার মার্কেটের আদর্শ ইউনিটের ফটকে যায়। কিছু দূরে মোটরসাইকেল রেখে টর্চলাইট নিয়ে আদর্শ ইউনিটের ফটকের দিকে যায় তাদের একজন। এর কিছুক্ষণ পরই দৌড়ে মোটরসাইকেলে উঠে পালিয়ে যায় ওই দুই যুবক।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, মোটরসাইকেলে আসা ওই দুই যুবকই মার্কেটে আগুন দিয়ে চলে যায়। বিষয়টি নিয়ে আগুন লাগার পরপরই দোকানিদের অনেকেই প্রকাশ্য গণমাধ্যমে কথা বলেন। যা নিয়ে প্রতিবেদনও হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। কিন্তু তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নাশকতা অভিযোগ বারবারই এড়িয়ে যাওয়া হয়। আগুন লাগার মাত্র ছয়দিনের মাথায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। যেখানে সিগারেট অথবা মশার কয়েল থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়েছে বলে জানানো হয়। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কথা উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য আরও কয়েকটি সংস্থা আলাদাভাবে তদন্ত করলেও সেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। এতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, প্রতিদিন মার্কেট বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের মূল লাইনও বন্ধ করে দেওয়া হতো। আগুন যেহেতু ভোরে লেগেছে, তাই বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে লাগার সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে যে নিরাপত্তারক্ষীর সিগারেটের আগুন থেকে অগ্নিকান্ডের কথা বলা হয়েছে, সেই হোসেন পাটোয়ারী অন্তত এক যুগ আগে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন। তার এমন বক্তব্য তখনই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বঙ্গবাজারের দোকানগুলো ভেঙে সেখানে বহুতল মার্কেট তৈরির পরিকল্পনা ছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। সাঈদ খোকন মেয়র থাকাকালেই বহুতল ভবনের নকশা তৈরি হয়। ওই সময় আহবান করা হয় মার্কেট নির্মাণের দরপত্রও। কিন্তু পুনর্বাসন ছাড়া নতুন মার্কেট নির্মাণে আপত্তি জানান ব্যবসায়ীরা। সিটি করপোরেশন তাদের দাবি না মানলে উচ্চ আদালতে যান দোকানিরা। শুনানির পর মার্কেট ভাঙতে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত।
এরপর ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হয়ে আবারও নতুন করে মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকান মালিকরাই নতুন মার্কেটে দোকান বরাদ্দ পাবেন বলে আশ্বাস দেন তিনি। এরই মধ্যে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল ‘মার্কেটটি ব্যবহারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ’ উল্লেখ করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। পাশাপাশি ডিএসসিসির পক্ষ থেকে দোকান মালিক সমিতিকে মার্কেট খালি করতে একাধিক নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়র তাপসের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। তাদের আশঙ্কা ছিল ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকায় নেওয়া দোকান একবার ছেড়ে দিলে আর ফিরে পাবেন না।
এছাড়া দোকান পেলেও অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হবে এমন ভয় থেকে ব্যবসায়ীরা দোকান না ছাড়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, তাদের সরাতে না পেরে সিটি করপোরেশনসহ স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে মার্কেট পুড়িয়ে দিয়েছে। বহুতল মার্কেট করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে তারা ব্যবসায়ীদের নিঃস্ব করে দিয়েছে। মার্কেট পুড়ে যাওয়ার নাটক মঞ্চস্থের পর ভবন নির্মাণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞারও কোনো গুরুত্ব থাকেনি। কোনো ঝামেলা ছাড়াই নতুন মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করে ডিএসসিসি। আগুন লাগার একদিন পার না হতেই ডিএসসিসির সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার তাপস নতুন করে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের কাজ শুরুর ঘোষণা দেন। ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, নতুন মার্কেট ভবনে পুরনো ব্যবসায়ীদের ছাড়াও অন্তত ২৫০টি অতিরিক্ত দোকান তৈরি হবে। যা বরাদ্দ দিয়ে সংশ্লিষ্টদের হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।
এদিকে রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর গত ২২ অক্টোবর বঙ্গবাজারে পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়ার অভিযোগ এনে ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী রাজধানীর মিরপুর এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন রিপন বাদী হয়ে ৫০০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ এনে শাহবাগ থানায় মামলাটি করেন। এর পরদিন মামলা দায়েরে বিলম্বের কারণ উল্লেখসহ আদালতে প্রতিবেদন পাঠায় পুলিশ।
ওই মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ডিএসসিসির সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন রতন, শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান, যুবলীগের শাহাবুদ্দিন, বঙ্গবাজার মার্কেট সমিতির সহ-সভাপতি নাজমুল হাসান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম।
তারা ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে পরস্পরের যোগসাজশে পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবাজারে অগ্নিসংযোগ করেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। মামলার আসামি সাবেক এমপি আফজাল বঙ্গবাজার এবং গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারসহ আশপাশের মার্কেটে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। আগুনের ঘটনায় স¤প্রতি শাহবাগ থানায় হওয়া মামলাটির তদন্ত করছেন এসআই মাইনুল ইসলাম খান পুলক।
তিনি বলেন, ‘মামলার দায়িত্ব পাওয়ার পর আমরা তদন্ত শুরু করেছি। প্রথমেই আসামিদের ধরার চেষ্টা করছি। আশা করছি তাদের ধরতে পারলে অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসবে। তাছাড়া অন্যান্য আলামত বিবেচনায় নিয়েও আমাদের তদন্ত চলছে।’ ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে আগুনে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি মার্কেট পুরোপুরি পুড়ে যায়। এছাড়া পোড়ে আশপাশের আরও তিনটি মার্কেট। পাশেই পুলিশ সদর দফতরের একটি বহুতল ভবনও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর ছিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। তা ছিল বঙ্গ, গুলিস্তান, মহানগর ও আদর্শ নামে চারটি ইউনিটে বিভক্ত। এর পাশেই ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এনেক্সকো টাওয়ার মার্কেট ও ইসলামিয়া মার্কেটও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আগুনে।
আরও পড়ুন
- ডলার কেনা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠিন নির্দেশনা
- পোশাক শিল্পে রফতানির ক্রয়াদেশ বাড়ছে
- বিশ্বব্যাংক থেকে ১০৮০০ কোটি টাকা ঋণ পেলো বাংলাদেশ
- রেমিট্যান্সে জোয়ার, ২১ দিনে এলো ২ বিলিয়ন ডলার
- আর্থিক খাতের শৃঙ্খলাসহ অর্থনীতিতে ৫ চ্যালেঞ্জ : ড. হোসেন জিল্লুর
- বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ পেল বাংলাদেশ
- পেঁয়াজ ও আলুতে স্বস্তি, বেড়েছে মুরগি ও চালের দাম
- খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, টাকা ছাপানোয় আইএমএফের উদ্বেগ