1. »
  2. শিক্ষা

নতুন পাঠ্যবইয়ে ছবি ঝাপসা, তথ্যে ভুল

বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২৪ ১১:০০ এএম | আপডেট: বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২৪ ০১:২৫ পিএম

নতুন পাঠ্যবইয়ে ছবি ঝাপসা, তথ্যে ভুল

নতুন বছরের শুরুতে শিশুদের হাতে বিনা মূল্যে যে পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রে ছাপা হয়েছে অযত্ন অবহেলায়। কাগজের মানে আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে। ছাপাও হয়েছে নিম্নমানের।

যেমন সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের একটিতে ৬৬ নম্বর পৃষ্ঠায় নৌকায় আরও কয়েকজনের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ছবি রয়েছে। কিন্তু ছবি পরিচিতি (ক্যাপশন) পড়া ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে সেটা বঙ্গবন্ধুর ছবি। ছবিতে থাকা অন্যদেরও কোনোভাবেই চেনা যায় না। 

১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারে গণমানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দিচ্ছেন এমন একটি ছবি রয়েছে একই বইয়ের ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠায়। সেটিও ঝাপসাভাবে ছাপা হয়েছে।

চারটি শ্রেণির বিভিন্ন বই সংগ্রহ করে দেখার পর শিক্ষক, অভিভাবক, মুদ্রণকারী এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার সরকারি সিদ্ধান্তেই বইয়ের উজ্জ্বলতা কমিয়ে ধরা হয়েছে। আর দুটি শ্রেণির বই শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করে ছাপতে যাওয়া, মুদ্রণকারীদের অতি মুনাফার লোভ ও গাফিলতি এবং তদারকির অভাবে বইয়ের ছাপার মান খারাপ হয়েছে। এখনো সবাই বই পায়নি। কারণ, ছাপা শেষ হয়নি।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৩১ কোটির মধ্যে কিছুসংখ্যক বইয়ে ভুলভ্রান্তি বা ছাপার কাজ কিছু খারাপ হওয়া অসম্ভব নয়। তবে নিয়ম অনুযায়ী, মুদ্রণবিভ্রাট ও ভুলত্রুটি হলে তা ১৫ দিনের মধ্যে ঠিক করে দেওয়া হয়। 

তিনি বলেন, অল্প কিছু বইয়ে মুদ্রণবিভ্রাট হয়েছে, সব জায়গায় নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।

অবশ্য বই নিয়ে এমন ‘গাফিলতি’ নতুন নয়। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবইয়ে ভুল ও অসংগতি নিয়ে বিতর্কের পর শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের অনুসন্ধানী পাঠ) আকস্মিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়। এবার বই দুটি পাঠ্য হিসেবেই রাখা হয়নি। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সব কটি বইয়ে ভুলভ্রান্তি ছিল, যা নিয়ে পরে সংশোধনী দেয় এনসিটিবি।

সরকার প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে নতুন পাঠ্যবই দেওয়া শুরু করে ২০১০ সাল থেকে। শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার জন্য আয়োজন করা হয় বই বিতরণ উৎসব। 

নতুন বই দিতে সরকারকে এ বছর প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি ৭১ লাখ। এবার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে নতুন বই পেয়েছে। বাকি শ্রেণিগুলোতে পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে বই দেওয়া হয়েছে। 

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিনা মূল্যে বই দেওয়ার সিদ্ধান্ত খুবই ভালো। এতে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি বেড়েছে, ঝরে পড়া কমেছে। কিন্তু বই ছাপা ও তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে অনেক শিশুর হাতে যাচ্ছে মলিন বই। যদিও শিশুদের বই হওয়া উচিত ভালো মানের কাগজে উন্নত মানের ছাপার।

শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, বই মুদ্রণ, ছাপা ও বিতরণ করে এনসিটিবি। সংস্থাটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন কর্মকর্তা বলেন, এবার কোনো কোনো বইয়ের ছাপার মান খারাপ হয়েছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। 

এবার যে বইয়ের মান খারাপ হতে পারে, তা আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কারণ, গতবার কাগজের উজ্জ্বলতা ধরা হয়েছিল ৮৫ শতাংশ। এবার তা কমিয়ে ৮০ শতাংশ ধরা হয়েছে। এনসিটিবির চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলামের দাবি, তাঁরা চক্ষুবিশেষজ্ঞদের পরামর্শে কাগজের উজ্জ্বলতা ৮০ শতাংশ করেছেন।

অবশ্য সূত্র বলছে, বিশ্ববাজারে ভালো মানের মণ্ড বা পাল্পের দাম বেশি। উজ্জ্বলতা বেশি রাখতে ভালো মানের মণ্ড দিয়ে তৈরি কাগজ ব্যবহার করতে হয়। গত বছরের মাঝামাঝিতে মুদ্রণকারীরা ভালো মানের মণ্ড না পাওয়ার কারণ দেখিয়ে উজ্জ্বলতায় ছাড় দেওয়ার দাবি করেন। এনসিটিবি সেটা মেনেও নেয়। 

এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র পাল বলেন, মুদ্রণ ব্যবসায়ীদের পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। তাই ভালো বই চাইলে নমুনা অনুযায়ী আদায় করতে হবে। নির্ধারিত নমুনা অনুযায়ী কোনো মুদ্রণকারী বই দিতে না পারলে সেসব বই বাতিল বা জরিমানা আদায় করতে হবে। ভবিষ্যতে ভালো মানের বই পেতে হলে এগুলো করতে হবে। 

সারা দেশে বছরের প্রথম দিন বই বিতরণের পর বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাপা ও কাগজের মান নিয়ে অভিযোগ পাওয়া যায়। রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার একটি বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ে আসা কিছু বইয়ের ছাপার মান খারাপ মনে হয়েছে। বাঁধাইও নিম্নমানের। প্রথম দিনই কোনো কোনো বইয়ের বাঁধাই খুলে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়। 

রাজধানীর মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক বলেন, তাঁর সন্তান ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সে যে ইংরেজি বই পেয়েছে, তার কিছু অংশ ঝাপসা। 

ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির বিভিন্ন বই ঘেঁটে দেখা যায়, প্রচ্ছদের কাগজ ও ছাপার মান ভালো। তবে ভেতরের কাগজের মান অনেক ক্ষেত্রেই ভালো নয়। কয়েকটি বইয়ের কাগজের মান আরও নিম্ন। ছবিও অস্পষ্ট। যেমন ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ের ১২১ নম্বর পৃষ্ঠার কিছু অংশে কী লেখা, তা অস্পষ্টতার কারণে বোঝা যায় না।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, তিনি বেশ কিছু বই দেখেছেন। এগুলোর মান খারাপ। তাঁরা কিছু বিষয়ে আগেই এনসিটিবিকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। ফলে এখন অনেক শিক্ষার্থী ভালো মানের বই থেকে বঞ্চিত হলো। 

সাতক্ষীরায় তৃতীয় শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার বই বিতরণের পর ৩১ হাজার ৪৭২টি বই ফেরত নেওয়া হয়েছে। ১ জানুয়ারি বই বিতরণ অনুষ্ঠানের কয়েক ঘণ্টা পর রাতে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও সহকারী কর্মকর্তা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তা ফেরত নিয়ে দ্রুত শিক্ষা অফিসে জমা দেওয়ার জন্য বলেন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক জানিয়েছেন, তাঁরা জেনেছেন যে এ বইয়ের মলাটের (প্রচ্ছদ) ভেতরের পাতায় ও শেষ পাতার ভেতরে কিছু ভুল হয়েছে। তবে সব বইয়ে ভুল হয়নি।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুহা. আবদুল গণি বলেন, সদর উপজেলায় ৮ হাজার ১৫০টি বই বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ২৩৩টি বইয়ের মলাটের ভেতরে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এমন বিষয়বস্তু পাওয়া যায়। 

এদিকে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, যাচাই করার পর দ্রুত ওই সব বই আবার শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে। 

এবার প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ শেষ হলেও মাধ্যমিকের শেষ হয়নি। ফলে বছর শুরু হলেও অনেক শিক্ষার্থী পুরো বইয়ের সেট পায়নি।

ঢাকার সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এ কে এম ওবাইদুল্লাহ বলেন, সেদিন পর্যন্ত অন্যান্য শ্রেণির বই এলেও অষ্টম ও নবম শ্রেণির কিছু বই আসেনি। 

এনসিটিবির সূত্রমতে, অষ্টম ও নবম শ্রেণির মোট ১০ কোটির কিছু বেশি বইয়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক বই ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাপা শেষ হয়নি। এনসিটিবির কর্মকর্তাদের আশা, এই দুই শ্রেণির অবশিষ্ট বই সর্বোচ্চ ১০ জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীরা পেয়ে যাবে। 

এনসিটিবির সবচেয়ে বড় কাজ হলো শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বই তৈরি। কিন্তু এনসিটিবির কর্মকর্তাদের অনেকেরই বেশি আগ্রহ থাকে বই মুদ্রণের কাজে। এ নিয়ে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের মধ্যেই নানা আলোচনা আছে।

এ অবস্থায় বই মুদ্রণের কাজটি এনসিটিবির হাতে না রেখে আলাদাভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান করে তাদের দায়িত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ। তিনি বলেন, এনসিটিবির মূল কাজ হলো শিক্ষাক্রম উন্নয়ন, গবেষণা ইত্যাদি কাজ করা। বই ছাপার কাজটি আলাদা হওয়া উচিত।

মনজুর আহমদ বলেন, বিনা মূল্যে নতুন বই দেওয়ার উদ্দেশ্য ভালো। কিন্তু শিশুদের হাতে ভালো মানের বই দেওয়া উচিত।